দুর্গা সিরিজ এপিসোড ১ । জানবাজারের রানী রাসমণির পুজো
মাতা আসিতেছেন। সপরিবার-কাম-বর, সবাহন-কাম-অসুর, পয়সা খরচের আদ্যশ্রাদ্ধ উপলক্ষ সহ মাতা আসিতেছেন। ফেসবুকীয় আঁতেলগণ ঘণ্টায় ঘণ্টায় অ্যানাউন্স চালাইতেছে বোধনের ঘণ্টা আর ঠিক কতো ঘণ্টা দূর, এবং যতই ঘণ্টা কমিতেছে ততই ৮ হইতে ৮০ মহিলাগণের ভিড় এবং বাজেট বিউটিপার্লারে বাড়িতেছে, তাহাতে গৃহে কর্তামহাশয়ের নাভিশ্বাস উঠিলেও তাঁহারা কেয়ার করিতেছেন না। ততই রাস্তায় বাঁশ পড়িতেছে, এবং কর্মস্থলে উপস্থিত হইতে দেরি হইবার নিমিত্ত আপনি রাস্তার দুরবস্থাকে বাঁশ দিতেছেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট বাঁশ খাইতেছেন। এই এতসব বাৎসরিক ঘটনা দ্বারা মর্ত্যে নিজ আগমন-বার্তা ঘোষণা করিয়া মাতা আসিতেছেন।
মায়ের এই আগমন-সংবাদ সহ আমাদের মিনিবচনের টিম বেরিয়ে পড়েছে কোলকাতার পথে, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত মাতৃপূজার ঐতিহাসিক প্রাচীন বর্ণনা তথা বর্তমান চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। পূজাপরিক্রমা এবার থেকে শুধু ভিডিওতে নয়, লেখাতেও হাজির। মিনিবচনের এই সিরিজটি স্পন্সর করছে সল্টলেক সেক্টর ২-এর একটি বিখ্যাত ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেলস MAKEEASYTRAVEL, আপনার ভ্রমণে আনে বিশ্বাসের ছোঁয়া। সারা পৃথিবীবিখ্যাত এই ঐতিহ্যকে পৃথিবীর সামনে মহিমান্বিত করতে আপনিও আমাদের একটু হেল্প করুন, আপনাদের এলাকার কোন মাতৃপূজার বর্ণনা আমাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করুন ছবি সহ, আপনি চাইলে আপনার পরিচিতিসহ আমরা আপনাদের পুজোর বর্ণনা আমাদের সিরিজে লিখবো।
‘ঢ্যাম কুড়াকুড় দুগ্গি ঠাকুর’ সিরিজে আজ ‘আমাদের যাত্রা হলো শুরু’ উইথ সেন্ট্রাল কোলকাতায় জানবাজারের রানী রাসমণির বাড়ি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ‘রানী রাসমণি’(২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ —১৯ ফেবরুয়ারি ১৮৬১) শোনার সাথে সাথে আপনার মনে যাঁর প্রোফাইল ভেসে উঠছে- ইনিই সেই। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা, ইংরেজদের সাথে গঙ্গার ইজারা নিয়ে পাঙ্গা নেওয়া, ইংরেজরা গোলমালের অজুহাতে পুজোর প্রসেশান আটকাতে চাইলে তার এগেন্সটে লড়াই করা- একের পর এক মহান কীর্তি আছে রানীদেবীর। এক্সেপশনালি সুন্দর হবার জন্যে মাত্র এগারো বছর বয়সে জানবাজারের তৎকালীন জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়, এবং এই বিয়ের পর থেকেই তিনি জানবাজারের জমিদার বাড়িটির কাছারি অংশে মা দুর্গার আরাধনা শুরু করেন, যা একই জাঁকজমকের সাথে স্টিল চলছে। এবং এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আর একজনের নামোল্লেখ না করাটা চরম অন্যায় হবে – শ্রী প্রীতিরাম দাস। ইনি কে? ইনি রানীদেবীর শ্বশুর ছিলেন, এবং এই পুজো শুরু করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
তবে এখন এখানে ২টি আলাদা পুজো হয় দুই শরিকের তরফে। রানী রাসমনির মেজ কন্যা কুমারীর বংশধরদের বাসস্থান ১৮/৩ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে একটি পুজো হয়। আরাধনা।বর্তমানে বিশ্বাস পরিবার এই পুজোটির দায়িত্ত্বে আছেন। দ্বিতীয় পুজোটি রানীদেবীর ছোট কন্যা জগদম্বা এবং ছোট জামাই মথুরামোহন (মথুরানাথ) বিশ্বাসের তরফে ১৩, রানী রাসমণি রোডে অবস্থিত কাছারি বাড়িতে হয় (রানীদেবীর সেজো মেয়ে করুণাময়ীর সাথে এঁর প্রথম বিবাহ হয়, কিন্তু বিবাহের দুই বছরের মধ্যে করুণাময়ী মারা গেলে ইনি রানী দেবীর ছোট মেয়ে জগদম্বাকে বিবাহ করেন। রানী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা পদ্মমণির বংশধরেরা বর্তমানে ২০, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে বসবাস করেন)। ঘাবড়াবেন না, আমি সঙ্গে গুগল ম্যাপ দিয়ে দিচ্ছি, তাই হারানোর ভয় নেই। তবে পথিকবর, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট দিয়ে ঢুকলে আপনার সামনে যে পুজোটি পড়ছে, সেটিই রানীদেবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুর্গা আরাধনা।বর্তমানে হাজরা পরিবার এই পুজোটির দায়িত্ত্বে আছেন, এবং পুজোর ঐতিহ্য কোনোভাবেই যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে তাঁরা সদা সতর্ক।
এই দুর্গামূর্তিতে প্রথম আপনার চোখে পড়বে দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মুখের রঙ- যা একে অন্যের থেকে আলাদা। দেবী এখানে ‘তপ্তকাঞ্চনবর্ণা’- অর্থাৎ তাঁর মুখের রঙ শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। বর্ধমান থেকে আসা শোলার সাজে সজ্জিতা দেবী এখানে একচালা, কারণ দেবী একান্নবর্তী পরিবার পছন্দ করেন (স্টার জলসার বাংলা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী)। J প্রতিমা তৈরিতে রয়েছেন লালু চিত্রকর এবং তাঁর ভাই দুলাল চিত্রকর। এঁরা বংশপরম্পরায় আহমেদপুর থেকে আসেন।
এই পুজোর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন- দেবী দুর্গার সাথে এখানে পঞ্চ মহাদেব ও রঘুবীর, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব এবং মা সারদার পুজোও করা হয়। কারণ, বলা হয়, ১৮৬৪ সালে রামকৃষ্ণদেব এই পুজোতে এসেছিলেন এবং ‘সখীবেশ’ ধরে পুজো করেছিলেন। এই সময়ে তিনি সন্ধ্যারতির সময়ে দুর্গা মাকে চামর দুলিয়ে বাতাস করেছিলেন, যা দেখে মথুরবাবু ভেবেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে কোন নিমন্ত্রিত স্ত্রীলোক মাকে চামর দুলিয়ে বাতাস করছিলেন। পরে তিনি জগদম্বা দেবীর থেকে জানতে পারেন, স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব ভাবাবস্থায় চামর হাতে মাকে বাতাস করেছিলেন। সেই থেকেই এই পুজোতে আজও ঠাকুরদালানে বাড়ির মহিলারা প্রতিমার বাম দিকে এবং পুরুষেরা ডান দিকে দাঁড়ান।
দেবীর বোধন হয় প্রতিপদে, অর্থাৎ আফটার মহালয়া, আর সপ্তমীতে হয় কল্পারম্ভ (ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত ‘installed’ শব্দটির অর্থ আমি বুঝলাম না, কারণ আই.টি. সেক্টরে কাজ করার দয়ায় ‘install’ বলতে আমি তো সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার ইন্সটলের কথাই বুঝি। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি বুঝলে কাইন্ডলি বুঝিয়ে দেবেন J)। আর এই প্রতিপদ স্টার্ট হবার সাথে সাথেই দেবীর হাজব্যান্ড মহাদেবের ১৫খানা মাটির মূর্তি তৈরি হয়, আর প্রতি একদিন একটি করে মূর্তির পুজো হয়। (হাজব্যান্ডকে অবহেলা করে কার সাধ্যি, তাহলে কৈলাসে গিয়ে বাবা মায়ের মাথা ঝগড়ায় খারাপ করে দেবেন না!!!)
লাস্টে দশমীতে দেবীর মূর্তির সাথে সব ক’টি মহাদেবের মূর্তিও একসাথেই জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই পুজোতে তিন দিন ব্যাপী ‘কুমারী পূজা’ চলে (সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী)। এই পুজোর ভোগ রান্না হয় গঙ্গাজলে, এবং এই সময়ে সর্বক্ষণ যে কোনো ব্যক্তির জন্যেই ভোগের ব্যবস্থা থাকে। বলা হয়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামীজি, নেতাজী, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বই এখানে নিয়মিত পুজোতে এসেছিলেন। এবং, আজও এখানে পুজোর ক’দিন সারা রাত্রিব্যাপী যাত্রা ও কবি গানের লড়াই-এর আসর বসে।
কেমন লাগলো আজকের এপিসোড? আপনাদের একটা ছোট্ট সহযোগিতা চাই, ভালো লাগলে লাইক এবং শেয়ার করুন, আর প্লিজ নিজের এলাকায় এমন কোনো মাতৃপূজার বর্ণনা আমাদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করুন ছবি সহ (বা ইনবক্সেও করতে পারেন), আপনি চাইলে আপনার পরিচিতিসহ আমরা আপনাদের পুজোর বর্ণনা আমাদের সিরিজে লিখবো।