The most popular entertaining gag site in India

NABA PURAN

শকুনি – এক বিহ্বল ভ্রাতা | Shakuni – The Worried Brother of Mahabharat

’ভক্ষক রূপে নয়, পুরুষদের রক্ষক রূপে শুভ হয়ে উঠুক আজকের পূর্ণিমা।‘

gandhari n mahabharat

অন্ধকার। গান্ধারীর আজন্মকালের ভীতির একমাত্র কারণ। গান্ধাররাজের নয়নমণি প্রাণচঞ্চল এই ছোট মেয়েটি সারাদিন ছুটে চলেছে বিশাল প্রাসাদে, সঙ্গী সুখদা। মা মুখে বকাঝকা করেন মেয়ে বাবার আদরে বাঁদর হচ্ছে এই বলে, তবে মনে মনে কিছুটা আস্কারাই দেন। মেয়ে হয়ে এসেছে, কটা দিনই বা আর হাসতে পারবে! কার ঘরে গিয়ে পড়বে,  রাজনীতির প্যাঁচে তখন হাসতেই ভুলে যাবে হয়তো! তার থেকে এখন না হয় একটু হেসেই নিক! আর দাদা শকুনিও পর্বতের মতো আগলে রাখে ছোট একরত্তি বোনটিকে। তাই মাঝে মাঝেই বোনের জন্যে শিশিভর্তি জোনাকিপোকা ধরে আনা থেকে রাত্রিবেলা গান্ধারীর ঘরে ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা – বোনের যে কোনো কাজেই দাদা এক পায়ে খাড়া। বোনকে রক্ষার জন্যে দাদা সদা সতর্ক। আর বোনও তেমনি। ঠিক জানে কোনো বদমাশি করলে মায়ের বকার হাত থেকে বাঁচার জন্যে দাদার পিছনে গিয়ে লুকোলেই হবে। একেবারে যাকে বলে সুখী গৃহকোণ।

আচমকা একদিন দুপুরবেলা ছাদে পুতুল খেলতে খেলতে ঈশানদিক থেকে এক আলোর ছটা এসে পড়ে গান্ধারীর চোখে। মেয়েটি প্রথমে ভাবে আকাশের সূর্যের রশ্মির প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু আলোটা তো বেড়েই যাচ্ছে!  কৌতূহলী হয়ে পুতুল সরিয়ে রেখে ছাদের আলসের ধার ঘেঁষে দাঁড়ায় গান্ধারী। ওমা! মাটির ওপরে জ্বলন্ত সাদা সূর্য! এতো তেজ মানুষের হয়! চোখ যেন ঝলসে যায় তার। মনে হয় স্বর্গ থেকে কোন দেবতা আসছেন গান্ধারে। দৌড়ে নিচে বাবাকে খবর দিতে ছোটে কিশোরীটি।
মেয়ের মুখে পুরো গল্পটি শোনার আগেই উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ান রানী- “ওগো! ভীষ্ম এসেছেন!”


কেঁপে ওঠেন রাজা সুবল। আর্যাবর্তখ্যাত এই মহাবীর আজ গান্ধারের দরজায়! রাজনীতির নিয়মানুযায়ী সুবল তো হস্তিনাপুরের শত্রু কোনো রাজ্যের সাথে সন্ধি করেন নি। বা যদিও মহারাজ বিচিত্রবীর্য মারা যাবার পরে সুদীর্ঘকাল যাবৎ হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন ফাঁকা রয়েছে, তবুও একটি বারের জন্যেও আক্রমণ করার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। তার একটি কারণ যদি পূর্বেকার রাজসন্ধি হয়, তবে অন্যটি অবশ্যই ভীষ্মের অসাধারণ বীরত্ব। ভীষ্ম যতোই প্রৌঢ়ত্বের দিকে চলেছেন, তাঁর বীরত্বও যেন ততোই বেড়ে চলেছে। এই অবস্থায় এই মহামতি তাঁর দ্বারপ্রান্তে কি ইচ্ছা নিয়ে এসেছেন? গান্ধার অধিকারের ইচ্ছা নিয়ে?

বাবার এই হতবিহ্বলভাব নজরে এড়ায় না গান্ধারীর। বয়সোচিত সারল্যে প্রথমে বিপদ বুঝতে পারেনা মেয়েটি। কিন্ত রাজকন্যা হবার সুবাদে রাজনীতিগত জ্ঞান তার বরাবরই তীক্ষ্ণ। আর ভীষ্মের ব্যাপারে সে বরাবরই সবকিছুই শুনে শুনে বড় হয়েছে, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ্যব্যপী সন্ত্রস্ত্র আয়োজন দেখে সব বুঝতে পারে মেয়েটি। বুঝতে পারে দেবতার ঔজ্জ্বল্যযুক্ত ভীষ্মের মনের আসল রূপ। গান্ধারের বিপদে হঠাৎ করেই এক লহমায় যেন কৈশোর টপকে যৌবনে পা রাখে রাজকুমারী, বড় হয়ে ওঠে গান্ধারদুহিতা, দেশমাতৃকার বিপদে জ্বলে  ওঠে গান্ধারীর দুই পদ্মপলাশের মতো চোখ।

নগরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন ভীষ্ম। গান্ধার থেকে যতক্ষণ না অভ্যর্থনা জানিয়ে কোনো রাজপুরুষ বাইরে আসছেন, ততক্ষণ নিয়ম নেই রথ থেকে নামবার। আর নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করার পরেও যদি কেউ না আসেন, তাহলে এই সেনাবাহিনীসুদ্ধ রথ চালিয়ে দেওয়া হবে গান্ধারের ওপর দিয়ে। যদিও ভীষ্মের প্রতিজ্ঞাসম্বলিত শান্ত কঠিন মুখ দেখে তাঁর মনোভাব আন্দাজ করা শিবেরও অসাধ্য, তবু রাজনীতিজ্ঞ এই প্রবীণের বিবেচনার সুখ্যাতি রয়েছে সারা আর্যাবর্ত জুড়ে। আর এই বিষয়ে প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে ভীষ্মের নিজেরও। কারণ, একমাত্র ভীষ্মের জন্যেই আজও  হস্তিনাপুর অরক্ষণীয় হয়েও অপরাজেয়। ভীষ্ম প্রাথমিকভাবে যা সিদ্ধান্ত নেবেন, হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে বর্তমানে সেটিই শেষ সিদ্ধান্ত। এক কথায়, হস্তিনাপুরের রাজা না হয়েও, সমগ্র আর্যাবর্তের মুকুটহীন সম্রাট তিনি। আর এই ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে প্রতিজ্ঞার আড়ালে লালন করেছেন তিনি। তাঁর আজীবন অবিবাহের প্রতিজ্ঞা তাঁকে লোকের চোখে মহান হিসাবে যেভাবে আখ্যায়িত করেছে, তা কালের প্রভাবে ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে গর্বে। তিনি চিরকুমার, এবং তিনি রাজা না হয়েও হস্তিনাপুরের ভাগ্যনিয়ন্তা – এই গর্ব কখন যে তাঁর এই সুমহান ব্রতের আড়ালে দম্ভে পরিণত হয়েছে, সেটা তিনি নিজেও জানতে পারেননি। আজ গান্ধারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য এক নতুন রাজনীতি রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এসেছেন। হস্তিনাপুরের যুবরাজ ধৃতরাষ্ট্র পূর্ণযুবক হয়ে উঠেছেন, সিংহাসনে রাজ্যাভিষেকের পূর্বে তাঁর বিবাহ আগামী কিছুকালের মধ্যে না দিলেই নয়। কিন্তু এতবড় রাজ্যের যুবরাজ অন্ধ। জন্মান্ধ। তাই নিকটবর্তী রাজ্যের রাজকন্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কন্যারা কেউই এক জন্মান্ধের সাথে সাত পাকে বাধা পড়তে রাজি নন। লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী  প্রভৃতি আর্য নারীদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেবার কুফল। মনে মনে বৈদিক যুগের আর্য নারীদের মুণ্ডপাত করেন ভীষ্ম। এদিকে হস্তিনাপুরের সমসামর্থ্যযুক্ত রাজ্যের রাজকন্যা আনার বিপদও কম নয়। কারণ, তাতে ভীষ্মের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। ভীষ্মের মতে রাজনীতিতে নারীদের কোনো স্থান নেই। ব্যতিক্রম- মাতা সত্যবতী। তবে সেখানেও ভীষ্ম মন থেকে যতটুকু আদেশ পালন করেন, জোর করে করেন তার থেকে অনেক বেশি। কারণ প্রজাদের ওপরে এই জেলে-বংশোদ্ভুত রমণীর প্রভাব লক্ষ্যণীয়। আবার এদিকে ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্যাভিষেক করানোর আগে তাঁর বিবাহ দেওয়া খুবই জরুরী। শোনা গিয়েছে, গান্ধার রাজের কন্যাটি যৌবনে পদার্পণ করতে চলেছে। সদ্য-রজোস্বলা কন্যাটির রূপও ফেটে পড়ছে নাকি। আর রাজ্যটিও খুব বেশি বড় নয়। একমাত্র কন্যা হবার সুবাদে হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে নাক গলাবার মতো সেরকম কেউ নেইও। কারণ একমাত্র রাজপুত্র শকুনির দায়িত্বে গান্ধার। তাই সু-রাজনীতিবিদ ভীষ্ম বহু বিবেচনা করে আজ এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। হয়তো ভীষ্মের এবং হস্তিনাপুরের যুগপৎ আক্রমনের ভয় দেখিয়ে এখানকার রাজকন্যাটিকে এই বিবাহে বাধ্য করা যেতে পারে!

অকস্মাৎ নগরের সিংহদরজা খুলে যায়। রথে চড়ে বের হয়ে আসেন গান্ধাররাজ ও তাঁর স্ত্রী। উপযুক্ত আদর-সৎকারের পরে আবাহন করেন ভীষ্মকে নগরের অভ্যন্তরে। যদিও গান্ধাররাজের মনে যথেষ্ট আতঙ্ক এখনো রয়েছে, তাও ভীষ্মের আদরের কোনো ত্রুটি হয়না।

কিন্তু ভীষ্মের মনে শান্তি কই! অচেনা এক সদ্য যৌবনোবতী নারীর চোখে এতো ঘৃণা কেন ভীষ্মের জন্যে? এতো রাগ? এতো নির্লিপ্ততা? এই কন্যা পা ধোওয়ার জল থেকে পানীয়জল নিয়ে আসা পর্যন্ত কোনো আতিথেয়তাতেই কোনো ত্রুটি দেখায়নি, কিন্তু এর সব কাজের মধ্যে যে নির্লিপ্তি রয়েছে, সেটা তৃতীয় কারো চোখে ধরা পড়াটাও অসম্ভব। এই চোখ যেন ভীষ্মের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা পরিকল্পনা বুঝে ফেলছে, এবং চোখ দিয়েই ধিক্কার জানাচ্ছে এক কন্যার সর্বনাশের(?) এই চিন্তাকে! সাধারণ এক দাসীকন্যা যে এ নয়, সেটি বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে কে এই কন্যা? যার চোখ এতো বাঙময়?

কৌতূহলের নিরসন হয় সান্ধ্যকালীন ভোজনের সময়ে। সন্ধ্যাহ্নিকের পরে রাজ পরিবারের সাথে ভীষ্ম বসেছেন আহারে। রাজকীয় সুখাদ্য পরিবেশনে রত দাসীরা। তাদের মধ্যে সুখদা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে গান্ধারীও। আহার করতে করতে ভীষ্মের পানীয়জলের প্রয়োজন হলে সেই মেয়েটিই জল ঢেলে দেয়, অথচ চোখে রাগ। আগুন এবং জলের এমন একত্র সহাবস্থান এর আগে দেখেননি ভীষ্ম। মহারাজ সুবলের সাথে আলাপচারিতার মধ্যে ভীষ্ম তুলে আনেন মহারাজের পরিবারের কথা। উত্তরে সুবল জানান, যুবরাজ শকুনি এখন মৃগয়ায় রাজধানীর বাইরে গিয়েছেন, কন্যা গান্ধারীই ভীষ্মের আহার্য পরিবেশন করছেন সখীদের সাথে, কারণ গান্ধারে আগত অতিথিকে দেবতার তুল্য দেখা হয়, আর নিজের হাতে দেবতার সেবা করাই রাজপরিবারের নিয়ম।

আহারের পরে মহামতি ভীষ্মের সাথে মহারাজ ও মহারানী কুশল আলাপচারিতায় বসেন। বিনীত ভাবে সুবল প্রশ্ন করেন ভীষ্মের আগমনের কারণ। সাথে সুবল এটিও জানান, যে আর্যাবর্তের নিয়মমতো উনি হস্তিনাপুরের অনুগত হিসাবেই আছেন। তাই ভীষ্মের এই হঠাৎ আগমনে তিনি শঙ্কিত। ভীষ্ম পর্দার অন্তরালে অলঙ্কারের একটি শব্দ পান, এবং অবশেষে অন্তরালবর্তিনীর উৎকন্ঠার কারণ বোঝেন। কিন্তু এই রমণীর চোখের আরো একটি রূপ দেখার লোভ সম্বরণ করতে না পেরে ভীষ্ম বলে ফেলেন, তাঁর আসার উদ্দেশ্য গান্ধারের রাজকন্যার জন্য একটি বিবাহ-সম্বন্ধ নিয়ে।  

বিবাহ! চমকে ওঠেন রাজা সুবল,অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠেন রানী সুবালা। প্রাণ পুত্তলিকা গান্ধারীকে অবশেষে সমর্পণ করতে হবে এই অশীতিপর ব্যূঢ়োঢ়স্ক প্রায়-বৃদ্ধের হাতে! যিনি কন্যার পিতার জ্যেষ্ঠের বয়সী!
এক লহমায় চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়! এতদূর কল্পনা করার সামর্থ্য বোধহয় গান্ধারীরও ছিলো না, তাই পর্দার আড়ালে ওই চোখদুটিতে যে ভাষা ফুটে ওঠে,  সেই আহত বিস্মিত দৃষ্টি বোধহয় পর্দার এই পার থেকেও, না দেখেও ভীষ্ম সহজেই অনুমান করতে পারেন। এক নিমেষের জন্যে নিজের প্রতিজ্ঞাকে ভুলে গিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চান নিজের ব্যর্থ হৃদয়ের হাহাকার, যে প্রাণ আজও প্রেমের অভাবে সারা জীবন পিয়াসী রয়ে গেছে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে নিজের  পর্বতসম কর্তব্য, সুমহান দায়িত্ত্ব। তাই সুগভীর যন্ত্রণায় সামলে নেন নিজেকে, এবং নিজের ওষ্ঠে জোর করে হাসির আভা এনে প্রশ্ন করেন, “কি হলো মহারাজ? নিজ কন্যার জন্য হস্তিনাপুরের সম্রাজ্ঞী হবার সম্মান কি আপনার যথেষ্ট পছন্দ হচ্ছে না?”

মুহূর্তে ওই চোখে বিদ্যুৎ অনুভব করেন ভীষ্ম। এবং বোঝেন, এই বিদ্যুৎ অদূর ভবিষ্যতে হস্তিনাপুরের ভাগ্যাকাশে আলোক শিখা জ্বালবে। ‘গান্ধারীর সাথে হস্তিনাপুরের যুবরাজের বিবাহ হবে’ – শুনে অবশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন সুবল। সানন্দ সম্মতির স্মিত হাসি মুখে নিয়ে তাকান পত্নীর দিকে। মহারানীর মুখেও ততক্ষণে ফুটে উঠেছে হাসির আভা। ভীষ্ম বোঝেন, পর্দার আড়ালের চোখ দুটি এবার হাসছে। কি অপূর্ব বাঙময় তার ভাষা!
ততক্ষণে সামনে বসে থাকা মহারাণী উৎফুল্ল মনে শুরু করেছেন হস্তিনাপুরের যুবরাজের গুণকীর্তন। যুবরাজ প্রজাপালক, যুবরাজ দয়ালু, যুবরাজ যুদ্ধনিপুণ… ভীষ্ম মগ্ন আপন চিন্তায়…হঠাৎ কানে এলো…”যুবরাজ পাণ্ডুকে জামাতা হিসাবে পাবার কল্পনাও কোনো দিন আমাদের ছিলো না”… অমোঘ নিয়তির মতো উচ্চারিত হয় ভীষ্মের বাক্য- ” এবং কোনোদিন এমন কল্পনাও করবেন না”!

এক মুহূর্তে থমকে যায় পরিবেশ। এই থমথমে ভাব যেন গান্ধারীর অন্ধকারভীতিকেও হার মানায়। তার মানে…তার মানে কি… “ধৃতরাষ্ট্র, যুবরাজ ধৃতরাষ্ট্র”- এর থেকে মৃত্যুদন্ডও যে অনেক বেশি সহনীয়! তাহলে কি আর্যাবর্তে কান পাতলে যে আলোচনা শোনা যাচ্ছে, হস্তিনাপুরের সম্রাট হতে চলেছে এক অন্ধ ব্যক্তি – সেটাই সত্যি! আর পদ্মপলাশলোচনা কন্যার জন্য এক অন্ধ পতি! আর সম্মত না হলে…. সেটাই ধ্বনিত হয় ভীষ্মের পরবর্তী বাক্যে- “ভেবে দেখুন মহারাজ, আপনার কন্যার রক্ষণে সদা নিযুক্ত থাকবে ১২ অক্ষৌহিণী  সৈন্য !!!” এটাই যেন ভীষ্মের আতঙ্ক দেখানোর ভঙ্গিমা। অর্থাৎ, ‘মহারাজ, আপনার অসম্মতির পরিণাম কিন্তু ভয়াবহ যুদ্ধ।’ পাথর হয়ে যান রাজদম্পতি। আর পর্দার আড়ালে অপেক্ষমানা সদ্যযৌবনা কন্যাটিও। এ কি ভীষণ পরিস্থিতি! রাজধর্ম এবং সন্তানস্নেহ আজ একে অন্যের সাথে দ্বন্দে লিপ্ত! রাজনীতিগত কুটিল নির্ণয়ের বলির যূপকাষ্ঠে আজ নিজ সন্তান! একদিকে সন্তানতুল্য প্রজা, যাদের রক্ষার শপথ তাঁর জীবনধারণের কারণ, অন্যদিকে নিজের রক্তজাত সন্তান – যে এই জীবনের আনন্দের উৎস!


কল্পনা করেন ভীষ্ম – এই চোখ দুটি এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টি সেখানে। বিনাদোষে আজীবন কারাবাসের আদেশ শুনলে যা হতে পারে আর কি!

মনে মনে হাসেন ভীষ্ম। আজ এই কন্যা তার এই দুর্ভাগ্যর কারণ হিসাবে ভীষ্মকে দায়ী করলেও, ভবিষ্যতে হস্তিনাপুরের সম্রাজ্ঞী হিসাবে যে ক্ষমতা,সম্মান এবং প্রতিপত্তি সে পেতে চলেছে- তার জন্যে আগামী দিনে ভীষ্ম তার কাছে দেবতা রূপেই পূজিত হতে চলেছেন। আর সেই ক্ষমতার কাছে পতির অন্ধত্বের দুঃখ – ধুর! ভীষ্ম নিজেও আজ যে সম্মান পাচ্ছেন, তার জন্যে তাঁকে নিজ বিবাহ এবং সিংহাসনের অধিকার ছাড়তে হয়েছে, সুতরাং বৃহৎ কিছু লাভের জন্যে ক্ষুদ্র কিছু ক্ষতি স্বীকার করতেই হয়- সেটাই ঠিক বলে ভীষ্ম ধরে নেন। কিন্তু তাতে অন্য ব্যক্তির সম্মতি আছে কিনা- ওসব আবার কে ভাবে!

এ কি ভয়াবহ ক্ষণ! চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবার সময় নেই, কারণ ভীষ্ম সাথে করে মাতা সত্যবতীর আশীর্বাদী কঙ্কণজোড়া নিয়ে এসেছেন, যা অস্বীকার করার অর্থ সাক্ষাৎ যুদ্ধ। পরামর্শ করার লোক নেই, পুত্র শকুনি রাজ্যের বাইরে। কন্যার সম্মতি নেবার পরিস্থিতি নেই, কারণ কোন মুখে এক পিতা তাঁর কন্যার সামনে অন্ধ পতি বরণের প্রস্তাব নিয়ে দাঁড়াবেন?

অকস্মাৎ সব সমস্যা ঘুচে যায়। বিদ্যুৎচমকের মতো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে গান্ধারী। চোখ তার মাটির দিকে নামানো। বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশের জন্য যথাবিহিত ক্ষমাভিক্ষা করে, প্রস্তরবৎ মুখে, মাটির দিকে তাকিয়ে, শান্ত গলায় উচ্চারিত হয় তার হিমশীতল স্বর -“পিতা, মহামতিকে বলুন, আমি সম্মত।”

বজ্রপাত হয় ঘরের মধ্যে যেন! মহারাজ সুবল ও মহারানী বাক্যাহত, ভীষ্ম শান্তমুখে বসে আছেন। তাঁর চিন্তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, অর্থাৎ আজও মানব-মানবী চরিত্র বৈশিষ্ট্য বোঝায় তিনি অদ্বিতীয়। এই কন্যাটি খ্যাতিলুব্ধা, তাই হস্তিনাপুরের রানী হবার জন্যে পতির অন্ধত্ব স্বীকার্য। এই কন্যাই ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ভীষ্মের অঙ্গুলিহেলনে চলবে, এবং ভীষ্মের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখবে আজীবন। শুধু আফশোস হয় ভীষ্মের, গান্ধারীর চোখ মাটির দিকে নামানো, তাই এই বিদ্যুৎ আর একবার দেখতে পেলেন না। তবে বিবাহের পরে সম্রাজ্ঞী হিসাবে দায়িত্ব শিক্ষণের সময় তা দেখতে পাবেন পুনরায়- সেটি ভেবেই ভীষ্ম তুষ্ট হন।

একসময়ে ঘরের নিস্তব্ধতা ভাঙে। ভীষ্ম বলেন, ‘তাহলে মহারাজ, শুভস্য শীঘ্রম। আগামী পূর্ণিমাতিথিতেই শুভকর্ম সুসম্পন্ন হবার অনুমতিক্রমে আমি আগামীকাল হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে চাই। অনুমতি দিন।”

এ কেমন অন্ধকার! ভীষ্ম চলে যাবার পর থেকে যতই হস্তিনাপুর থেকে উপঢৌকনাদি আসছে, গান্ধারীর জীবন যেন ততোই অন্ধকূপের গভীরে প্রবেশ করছে। এ যেন বলির পূর্বে পশুকে তুষ্ট করার নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা। এক রাজবাড়ি আলোয় সেজে উঠছে, আর এক রাজবাড়িতে অন্ধকার তার আজীবন আধিপত্য বিস্তার করছে।

ফিরে এসেছেন শকুনি। স্থিরবুদ্ধি, রাজনীতিজ্ঞ, অকুতোভয় হিসাবে খ্যাত এই প্রজ্ঞাবান তরুণ মহাবীর না হলেও, মহাজ্ঞানী তো বটেন। প্রাণপ্রিয়া ভগিনীর এই সিদ্ধান্তগ্রহণে তিনি আহত হলেও, ভগিনীর বিবেচনায় তিনি গর্বিত। সাথে প্রজাদের মঙ্গলার্থে গান্ধারীর এই আত্মবলিদানে তিনি গান্ধারীকে নিয়ে মুগ্ধও বটেন।

আজ পূর্ণিমাতিথি। আর্থিকভাবে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন রাজ্য হস্তিনাপুর তার কুলগৌরব বজায় রাখার জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট রাজ্য গান্ধারে নিজের যুবরাজকে নিয়ে আসার ভদ্রতাপূর্ণ ব্যবহারটুকুও করেনি। তাই বিবাহবাসর বসেছে হস্তিনাপুরেই। বাধ্য হয়ে, অপমান সহ্য করেও, গান্ধার রাজপরিবার কন্যাসহ এসে উঠেছেন এখানেই। তাতে যুবরাজ শকুনির সুগভীর অভিমান ভীষ্মের ওপর বেড়েছে বই কমেনি। তবুও স্নেহের গান্ধারীর জন্য সেটুকুও স্বীকার।

বিবাহের লগ্ন সমাগত। কন্যা সম্প্রদানের সময় সমুপস্থিত। বিবাহবাসরে কন্যা প্রবেশ করে। সবার চোখ সালঙ্কারা কন্যার দিকে পড়ে। অকস্মাৎ বজ্রপাত হয় সভাস্থলে। এমন বজ্রপাত ভীষ্মের প্রস্তাবকালে গান্ধারেও হয়নি। সভাস্থলে উপস্থিত আর্যাবর্তের সমস্ত রাজার সামনে হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ ‘সম্রাজ্ঞী’ পদাধিকারী কন্যা আবির্ভূত হন দুই চোখে বস্ত্রাবৃত অবস্থায়!!!

সবার সম্মিলিত কূট বাক্য, ধিক্কার, সর্বোপরি মাতা সত্যবতীর ক্ষিপ্ত আদেশ উপেক্ষা করে, নিজ সিদ্ধান্তে অটল গান্ধারীর মুখ থেকে একটি বাক্যই উচ্চারিত হয়- “হস্তিনাপুরের যুবরাজের বর্তমানে যতটুকু অধিকার আছে, পত্নী হিসাবে যুবরাজ্ঞীরও ঠিক ততটুকুই অধিকার থাকা উচিত। কারণ, স্বামীকে অতিক্রম করে যাওয়া স্ত্রীর পক্ষে অধর্ম।”

স্তব্ধ সভা। হতবাক রাজপরিবার। নতমস্তক ভীষ্ম। এক লহমায় তিনি আজ বোঝেন, নারী চরিত্র কোমল এবং দৃঢ় – দুটোই হয়। এবং গান্ধারী সেই কোমল-গান্ধার, যাঁর চরিত্র দুটোর মিশ্রণ। তাই এই নারী ভীষ্মের অঙ্গুলিহেলনে চলার মতো নন। তাঁর স্বাভিমান আছে, যা অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করে। কখনো তা উচ্চগ্রামে, কখনো নিজের ওপর তার প্রতিফলন দেখিয়ে। ভীষ্ম মহান, কিন্তু তাঁর  চরিত্রের এই অন্ধকারময় দিকটি ভবিষ্যতের সামনে আলোকিত করার জন্যে গান্ধারীর এই আত্মবলিদান! আফশোস থেকে যায় ভীষ্মের আজীবন – আর কখনোই সেই বিদ্যুৎবর্শিকা দুটি চোখ দেখা হবেনা!

কিন্তু আক্ষেপে ছিন্নভিন্ন হয় এক ভ্রাতার হৃদয়। হাহাকার করে উঠতে চায় শকুনির বুক থেকে। ভগিনী গান্ধারীর এই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের পিছনে ভীষ্মের প্রতি, তাঁর বিবেচনার কতোখানি অভিমান সুপ্ত রয়ে গেলো – সেটি ত্রিলোকে এর কেউ না বুঝুক, শকুনির ভ্রাতৃহৃদয় সম্পূর্ণ বুঝেছে। তাই সেই বিবাহস্থলে দাঁড়িয়ে, স্নেহের ভগ্নীর বিবাহে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকেই মনে মনে সাক্ষী রেখে শকুনি প্রতিজ্ঞা করেন, আজীবন গান্ধারীকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন যেভাবেই হোক। যতো বড় ক্ষতি গান্ধারীর হয়েছে আজ, হস্তিনাপুর রাজবংশকে তার ১০০গুণ মূল্য পরিশোধ করতেই হবে। এটিই এক বোনের কাছে তার ভাইয়ের প্রতিজ্ঞা। জটিল রাজনীতির আশ্রয় নেওয়া ভীষ্মের সমগ্র পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেবার কুটিল পণ গ্রহণ করেন তিনি। সূচনা হয় এক নতুন রাজনৈতিক যুগের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *